April 26, 2024, 8:23 am

কারাগারে থাকতে প্রতি মাসে দিতে হয় পাঁচ-ছয় হাজার টাকা!

২৫ নভেম্বর ২০২০, বিন্দুবাংলা টিভি. কম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি:

‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কারাগারের এই স্লোগান দেয়ালেই সীমাবদ্ধ। আলোর পথ দেখানোর পরিবর্তে এখানে চলছে অনিয়ম ও দুর্নীতি। কারাবন্দিদের নির্যাতন, সাক্ষাৎ, সিট, খাবার, চিকিৎসা ও জামিন দেওয়ার বিষয়ে অর্থ আদায় করে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী। পরে সেগুলো কারারক্ষীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারার অভিযোগে উঠেছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে নেমে এসব অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বলেও জানা গেছে। এখন অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কারাগারে প্রথম বন্দিদের যেখানে রাখা হয় তাকে ‘আমদানি কক্ষ’ বলা হয়। পরে বন্দিদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ‘বিক্রি’ করা হয়। ওয়ার্ড নিয়ন্ত্রণ করে পুরোনো বন্দি ও কারারক্ষীরা। ওয়ার্ড থেকে হাসপাতালে চিকিৎসার নামে বিক্রি হয় সিট। হাসপাতালে থাকতে প্রতি মাসে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা উৎকোচ দিতে হয়। এ ছাড়া অন্যান্য ওয়ার্ডে থাকতে দিতে হয় তিন-চার হাজার টাকা। পুরোনো কারাবন্দিরাও থাকেন দাপটে। পুরোনো বন্দিরা কারা কর্মকর্তাদের অর্থ দিয়ে ওয়ার্ডগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বাণিজ্য করে থাকে। নতুনরা টাকা না দিলে হয়রানি করা হয়। জীবন নামে এক ম্যাট বর্তমানে আমদানি কক্ষ নিয়ন্ত্রণ করে বলে জানা গেছে।

করোনাভাইরাসের অজুহাতে আমদানি কক্ষে আটকে রাখা হয় বন্দিদের। আবার দুই হাজার ৫০০ টাকা দিলেই অন্য ওয়ার্ডে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। কারা কর্তৃপক্ষ ঘুষের টাকা পরিবারের কাছ থেকে বিকাশে গ্রহণ করে। বন্দি অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে তাকে আমদানি কক্ষেই রেখে দেওয়া হয়।

কারাগারের নিয়ন্ত্রণে দুটি ক্যান্টিন রয়েছে। একটি কারাগারের ভেতরে, অন্যটি বাইরে। বাইরের ক্যান্টিনে কোনো মূল্য তালিকা নেই। ভেতরের ক্যান্টিনের পরিবেশ নাজুক। দুই ক্যান্টিনেই সিগারেট, কলা, বিস্কুট, কেক, আপেলসহ সব পণ্যের দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে। বন্দিদের পিসিতে (প্রিজনার ক্যাশ) এক হাজার পাঠালে ২০ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়। অথচ রসিদে লেখা হয় এক হাজার টাকা।

জামিনে বেরিয়ে আসা একাধিক ব্যক্তি জানান, কারাগারের প্রতিটি ওয়ার্ড ইজারা দেওয়া হয়। ম্যাট, সিও ম্যাট, পাহারাদার ও ওয়ার্ড রাইটার এসব ওয়ার্ড বরাদ্দ নিয়ে থাকে। নির্দিষ্ট ইজারামূল্য কারা কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করতে বাধ্য করে তারা।

বুলবুল আহমেদ নামের এক বন্দি কিছু দিন আগে মুক্তি পান। তিনি সোনা মসজিদের পিয়ারকাটি এলাকার মোজাম্মেল হকের ছেলে। মোজাম্মেল হক অভিযোগ করেন, করোনার সময় তার ছেলেকে জেলখানা থেকে মুক্ত করতে গিয়ে ৩ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।

জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় কারাবন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ বন্ধ রয়েছে স্বজনদের। তবে প্রতিদিনই টাকা নিয়ে স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। অফিস কল এবং সাক্ষাৎকালে টাকা আদায়ের সঙ্গে কারারক্ষী, প্রধান কারারক্ষী ও ডেপুটি জেলার জড়িত। পরে এই টাকা জেলার এবং জেল সুপারের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়।

সরেজমিন প্রতিদিন সন্ধ্যায় কারাগারের সামনে জামিনপ্রাপ্ত আসামির স্বজনদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে দেখা যায়। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। বন্দিরা আদালত থেকে জামিনলাভ করলেও টাকা না দিলে জামিননামা আটকে রেখে মুক্তি বিলম্বিত করা হয়। এর জন্য সর্বনিম্ন এক হাজার টাকা দিতে হয়। অভিযোগ আছে, বন্দিদের খাবার, স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ, কারাগারে ভালো স্থানে থাকার ব্যবস্থা- এসব কিছু চলে টাকার বিনিময়ে।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আগের জেল সুপার শফিকুল ইসলাম খানকে অনিয়মের দায়ে বদলি করা হয়। আর এ নিয়ে দুদকের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চলছে বলেও সূত্রটি জানায়। এদিকে চলতি বছরের ২৬ জুলাই একটি গোয়েন্দা সংস্থা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ আদালতের এক আইনজীবী জানান, আদালত থেকে আসামির জামিনাদেশ পাওয়ার পরও কারা কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে কালক্ষেপণ করে। বিভিন্ন সময় দাঁড়ি-কমার ভুল দেখিয়ে নানা অজুহাতে আসামিপ্রতি দুই-তিন হাজার টাকা দাবি করে। ঘুষের টাকা না দিলে মুক্তি দিতে টালবাহানা করে।

জেল সুপার মুজিবুর রহমান মজুমদার বলেন, এক সময় এসব অনিয়ম কারাগারে হতো বলে শুনেছি। তবে এখন এ কারাগারে কোনো অনিয়ম হয় না।


আপনার মতামত লিখুন :

মন্তব্য করুন


ফেসবুকে আমরা