March 28, 2024, 8:55 pm

অভিযোগপত্রে ভোট প্রসঙ্গ গায়েব, সংশয়ে ন্যায়বিচার

সুবর্ণচরে গণধর্ষণের শিকার নারীর অভিযোগ ছিল, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজের পছন্দের প্রতীকে ভোট দেওয়ায় তাঁর ওপর নির্যাতন হয়েছে। কিন্তু মামলার অভিযোগপত্রে নির্বাচনের প্রসঙ্গটি চেপে গেছে পুলিশ। তারা বলছে, পূর্বশত্রুতার কারণে ওই নারীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। যদিও পূর্বশত্রুতার কোনো বিবরণ অভিযোগপত্রে পুলিশ উল্লেখ করেনি।

অভিযোগপত্রে পুলিশ ইচ্ছা করেই নির্বাচনের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ায় ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী নারী ও তাঁর স্বামী। এর আগে মামলার এজাহারেও পুলিশ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করেনি। মামলার বাদী ওই নারীর স্বামী বলেন, তিনি লেখাপড়া জানেন না। ফলে পুলিশ এজাহারে কী লিখেছে, তা বুঝতে পারেননি। তাঁকে না জানিয়েই এজাহারে বলা হয়েছে, পূর্বশত্রুতার জের ধরে তাঁর স্ত্রী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

গতকাল শুক্রবার সুবর্ণচরের ওই নারীর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। মূল সড়ক থেকে একটু ঢালুতে চৌচালা টিনের ঘর তাঁর। ঘরের সামনে উঠানে বসে কথা হচ্ছিল। তিনি বলেন, গত ২৭ মার্চ অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার আগের দিন মামলাটির তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কর্মকর্তারা তাঁকে ও তাঁর স্বামীকে ডেকে নিয়ে যান। সেখানে (ডিবি কার্যালয়ে) অভিযোগপত্র পড়ে শোনানো হয়। তখন তিনি তাঁদের বলেন, ‘মিছা কথাখান কার লাই লিখছেন। আঁর কি জাগাজমিন আছে, টিঁয়াপয়সা আছে? ঝি-পুত বিয়া দিসিনি কোনো? আসামিগোর লগে হুরান ভেজাল (পূর্বশত্রুতা) কিয়ের? আশপাশে মানুষ আছে, দেশে মানুষ আছে, কাউরে কইতে হইব তো হুরান ভেজাল।’ ওই নারীর বক্তব্য শোনার পর ডিবির পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন বলেছিন, অভিযোগপত্রে যা আছে, তাতেই আসামিদের জেল-ফাঁসি হয়ে যাবে।

সুবর্ণচরের চার সন্তানের মা গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর রাতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাতে নিজ ঘরে গণধর্ষণের শিকার হন। এই ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় হয়, দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে বিষয়টি ফলাও করে প্রচারিত হয়। প্রশ্নবিদ্ধ আচরণের কারণে সুবর্ণচরের চরজব্বর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিজামউদ্দীনকে প্রত্যাহার করা হয়।

গত ৩১ ডিসেম্বর ভুক্তভোগী নারীর স্বামী সুবর্ণচরের চরজব্বর থানায় এজাহার দায়ের করেন। এ ঘটনায় তদন্তের পর পুলিশের অভিযোগপত্রটি গ্রহণের ব্যাপারে নোয়াখালীর জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে আগামী ৮ মে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে গত ২৭ মার্চ পুলিশ অভিযোগপত্রটি জমা দেয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।

ডিবির পরিদর্শক মো. জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিচার তো হবে ধর্ষণের। নির্বাচন এখানে মুখ্য বিষয় নয়। ওরা গ্রামের মানুষ, তাই এসব বলছে। তা ছাড়া অভিযোগপত্রভুক্ত আট আসামি আদালতে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন, সেখানেও নির্বাচন প্রসঙ্গ আসেনি।

ভুক্তভোগী পরিবারটি বলছে, শুরু থেকেই মামলাটি থেকে নির্বাচন প্রসঙ্গ বাদ দেওয়ার চাপ ছিল। নোয়াখালী জেলার পুলিশ সুপার ইলিয়াস শরীফ ঘটনার পরপরই বলেছিলেন, পূর্ববিরোধের জের ধরে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনের কোনো ব্যাপার নেই।

এসব বিষয়ে বাদীর আইনজীবী রবিউল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবে পুলিশ এমন অভিযোগপত্র দিয়েছে। এই শঙ্কা আগে থেকেই ছিল। তবে তিনি বলেন, অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে তাঁরা নারাজি দেবেন না। তবে ভুক্তভোগী নারী বলেছেন, অভিযোগপত্রে যা-ই থাকুক না কেন, আদালতে তিনি তাঁর কথা নিজেই বলবেন।

ওই নারীর স্বামী সুবর্ণচরের চরজব্বর থানায় গণধর্ষণের পূর্বাপর সব ঘটনা খুলে বলেছিলেন। কিন্তু পুলিশ এজাহার থেকে নির্বাচন প্রসঙ্গ ও সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক রুহুল আমিনসহ পাঁচ আসামির নাম প্রথমে বাদ দিয়েছিল। পরে অবশ্য রুহুল আমিনকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি দল থেকেও বহিষ্কার করা হয়।

অভিযোগপত্রে যা আছে
মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে চরজব্বর থানার পুলিশ। পরে তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিবি। অভিযোগপত্রে ডিবি বলেছে, ঘটনার শুরু ৩০ ডিসেম্বর রাত ১২টা ৩৫ মিনিট থেকে। ওই সময়েই অভিযুক্ত ব্যক্তিরা মামলার বাদী ও তাঁর স্ত্রীর ঘরে ঢোকেন বলে এজাহারে উল্লেখ আছে। তবে এর আগে-পরে কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে পুলিশ কিছু বলেনি। পুলিশ অভিযোগপত্রে বলেছে, আসামি রুহুল আমিন ও হাসান আলী ওরফে বুলুর সঙ্গে মামলার বাদী ও গণধর্ষণের শিকার নারীর পূর্বশত্রুতা ছিল। তাঁদের প্ররোচনা ও নির্দেশনায় মো. সোহেল, মো. হানিফ, মো. স্বপন, মো. চৌধুরী, ইব্রাহীম খলিল ওরফে বেচু, বাদশাহ আলম ওরফে কুড়াইল্যা বাসু, আবুল হোসেন ওরফে আবু, মো. মোশাররফ হোসেন, মো. সালাউদ্দীন, হাসান আলী, মো. মুরাদ হোসেন, জামাল ওরফে হেঞ্জু মাঝি, মো. মিন্টু এবং সোহেল বাদীর স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন। পরে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে বাড়ির উঠানে নিয়ে আসামি মো. সোহেল, মো. জসিম ও সোহেল লাঠি দিয়ে বেদম মারধর করেন। তাঁর শরীরে গুরুতর জখম ছিল। আসামি সালাউদ্দীন ও জসিম ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে ঘরের টিনের বেড়া ও দরজা কেটে প্রায় পাঁচ হাজার টাকার ক্ষতি করেন। তিনি আসামিদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও মারধর করার অভিযোগ সত্য বলে অভিযোগপত্র জমা দেন।

পুলিশ জানায়, এই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত ১৬ আসামির মধ্যে এখন কারাগারে রয়েছেন ১১ জন। বাকি পাঁচজন ঘটনার পর থেকেই পলাতক। তাঁরা হলেন মো. হানিফ, মো. চৌধুরী, মোশাররফ হোসেন, মো. মিন্টু ও মো. সোহেল।

চরজব্বর থানা সূত্রে জানা গেছে, রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ও আরেক আসামি ইব্রাহীম খলিলের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। আসামিদের সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থক।

ঘটনার শিকার নারীর অভিযোগ, তাঁকে যে ভোটের দিন সকাল থেকে শাসানো হচ্ছিল, সে কথা জেনেশুনেও পুলিশ লেখেনি। তিনি বলছেন, নির্বাচনের আগের দিন রুহুল আমিনের লোক হাশিম মাঝি এসে তাঁদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার কথা বলে যান। না গেলে ঝামেলা আছে বলেও শাসান। তাঁদের কেন্দ্র ছিল উপজেলার ১৪ নম্বর মধ্যম বাগ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তিনি অটোরিকশায় করে আরও তিন নারীর সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে যান। ভোটকেন্দ্রে ঢুকেই দেখেন রুহুল আমিনের অনুগত লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান করছেন। তাঁরা তাঁকে নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে বলেন। তিনি কেন্দ্রের দোতলায় উঠে সাদা কাপড়ে ঘেরা গোপন কক্ষে (বুথ) ভোট দিতে যেতে চাইলে তাঁকে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বলা হয়। সে সময় অন্য নারীদেরও সবার সামনেই ভোট দিতে দেখেন তিনি। প্রকাশ্যে ব্যালট পেপারে নিজের পছন্দের প্রতীকে সিল দিয়ে বাক্সে ফেলার পরই তিনি খেয়াল করেন, যে ব্যক্তির সামনে তিনি ভোট দিলেন, তিনি ইশারায় নিচতলায় থাকা লোকজনকে কিছু একটা (অন্য প্রতীকে ভোট দেওয়ার কথা) বলছেন। পরে কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে অটোরিকশায় ওঠার সময় আসামি সোহেল ও বেচু তাঁকে বলেন, ‘বিকেলে খবর আছে।’ এ সময় তিনি ‘আল্লাহ যা করে’ বলে চলে যান।

সেই রাতে ঘটনার শিকার নারী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা ঘুমিয়ে পড়লে রাত সাড়ে ১২টার দিকে দরজায় কেউ আঘাত করেন। পরিচয় জানতে চাইলে বলেন, তাঁরা আইনের লোক। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে নির্যাতনের শিকার নারীর স্বামীকে প্রথমে মারধর করেন আসামিরা। পরে ওড়না ও মাফলার দিয়ে বাড়ির সবাইকে বেঁধে ফেলেন। তারপর তাঁকে (ওই নারী) বাড়ির বাইরে বের করে এনে আসামিরা লুঙ্গি দিয়ে মুখ চেপে ধরেন ও পায়ে আঘাত করেন। একপর্যায়ে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে পুকুরপাড়ে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করেন আসামিরা। মুখের বাঁধন খুলে দেওয়ার পর তিনি শুধু একটি কথাই আসামিদের বলেছিলেন, ‘পোলাফাইন মা ডাকব কারে?’ তাঁর বক্তব্য, পূর্বশত্রুতার জেরেই যদি এই পরিণতি হতো, তাহলে সেটা নির্বাচনের রাতেই কেন হলো?

ধর্ষণের শিকার ওই নারীর সঙ্গে যাঁরা ভোট দিতে গিয়েছিলেন, এমন দুই নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন ভোটকেন্দ্রে তাঁরা লাঠিসোঁটা হাতে রুহুল আমিনের লোকজনকে দেখেছেন।

চাপ ছিল বরাবরই
নির্যাতনের শিকার নারী বলছেন, তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন। সব জায়গায় তাঁর বর্ণনা ছিল একই রকম। তবে নির্বাচনের প্রসঙ্গ না আনার চাপ ছিল বরাবরই। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর কাছে সাদাপোশাকে চার ব্যক্তি আসেন। তাঁরাও এ নিয়ে মুখ না খোলার ব্যাপারে সতর্ক করেন। কিন্তু তিনি চুপ থাকেননি, ভবিষ্যতেও থাকবেন না বলে জানান।


আপনার মতামত লিখুন :

মন্তব্য করুন


ফেসবুকে আমরা