March 28, 2024, 11:20 am

ক্ষমতা নিরঙ্কুশ ও ভিন্নমত দমনে ব্যবহার হচ্ছে ডিজিটাল আইন

২৭ জুন ২০২০, বিন্দুবাংলা টিভি. কম,

নিউজ ডেস্ক ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কিছু লিখলেই মামলা হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। তাহলে এই মামলাটি কি শুধু ভিন্নমত দমনের জন্যই করা হয়েছে? স্বাধীন সাংবাদিকতায় এই আইনটি কতটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এই আইনটি বাতিল এখন সময়ের দাবি। ভিন্নমতও কিন্তু সরকার পরিচালানায় সহায়ক। অথচ করোনার মধ্যে আমরা দেখছি, এই আইনটির অপব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে।

ডয়চে ভেলে : করোনার এই সময়েও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হচ্ছে৷ এই আইন ও তার প্রয়োগ কিভাবে দেখছেন?

অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন : ২০০৬ সালে যখন যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন করা হয়েছিল তখনই কিন্তু সবাই এটার প্রতিবাদ করেছিলেন। ২০১৩ সালে এটা সংশোধন করে শাস্তির মাত্রা আরো কঠোর করা হয়েছিল। তখন ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ হচ্ছিল, সবাই এটার প্রতিবাদ করেছেন। ২০১৮ সালে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া হয় তখন কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম ওই ৫৭ ধারাই নানাভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হলো। তখন কিন্তু সম্পাদক পরিষদ, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন বা টিভি মালিকদের সংগঠন এটার প্রতিবাদ করেছিলেন। সংসদীয় কমিটির সামনেও যুক্তিগুলো উপস্থাপন করা হয়েছিলো। তারপরও এটা পাশ হয়ে গেল। সমস্যা হচ্ছে এটার খুব বেশি অপপ্রয়োগ আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই ধরনের আইনগুলো করাই হয়, ক্ষমতাবানদের স্বার্থরক্ষার জন্য। যেটা সম্প্রতি সাবেক মন্ত্রী প্রবীণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ বলেছেন। এই কোভিডের মধ্যে আমরা কতগুলো দুঃখজনক ঘটনা দেখলাম। রাষ্ট্রচিন্তার দিদারুল ভূঁইয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হলো। দিদারুলকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি ত্রাণ নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি লিখেছেন, যে সমস্ত এলাকা খুবই গরীব সেখানে ত্রাণ যাচ্ছে খুবই কম। সাংবাদিক কাজলকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। একজন সাবেক মন্ত্রীর মৃত্যুর পর একটা মন্তব্য নিয়ে একজন শিক্ষককে গ্রেফতার করা হলো। এমনকি একটা নবম শ্রেনীর ছাত্রকেও সেদিন এই মামলায় ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। করোনায় সময় এই আইনের অপব্যবহারটা আরো বেড়ে গেছে।

তাহলে আপনি মনে করছেন ভিন্নমত দমনে আইনটির ব্যবহার, বা অপব্যবহার হচ্ছে?

এটা আসলে ভিন্নমত দমনের জন্যই। আপনি যদি একটু খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন ওয়াজে নারীদের সম্পর্কে, বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে যে সমস্ত কথাবার্তা হচ্ছে, বিশেষ করে মেয়েদের সম্পর্কে। তারপর বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে, যেমন আমেরিকা, ট্রাম্প সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে। কিন্তু বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়, এমন কিছু লেখা যাবে না। যে ক্লেজগুলো আছে। এগুলো দেখলেই বুঝবেন যে কি ধরনের অপচর্চা সেখানে হয়। তাদের কিন্তু কখনই গ্রেফতার করা হয় না। গ্রেফতারটা কাদের করা হচ্ছে, যারা সরকার বা রাষ্ট্র কাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কিছু বলছেন তাদেরই গ্রেফতার করা হচ্ছে।

অধিকাংশ মামলাই রাজনৈতিক ব্যক্তিরা করছেন। সব ধরনের পেশাজীবীদের বিরুদ্ধেই মামলা হচ্ছে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কী একটু বেশি হচ্ছে?

কারণ সাংবাদিকরাই এই জিনিসগুলো সামনে নিয়ে আসছেন। দেশে মেইনস্ট্রিমের সাংবাদিকেরা অনেক ভালো কাজও যেমন করছেন আবার কিছু বিষয় বলতেই হয়। যেমন ধরেন প্রধানমন্ত্রী যখন সাংবাদিক সম্মেলন করেন তখন সাংবাদিকেরা কি ধরনের প্রশ্ন করেন? তাদের প্রশ্ন করার ধরন দেখলেই বোঝা যায়, সাংবাদিকেরা তাদের জায়গা থেকে প্রশ্নটা করছেন না। তার মানে তারা কতটা কম্প্রোমাইজ করছেন। এত নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও কেউ যদি একটু বিরুদ্ধ মতের কথা বলেন বা কেউ যদি ক্ষমতাসীনদের অপকর্মের কথা বলেন তাহলে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে এবং এই আইনে মামলা দেওয়া হচ্ছে। হাইকোর্ট কিন্তু সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ও ৩১ ধারা কেন সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা হবে না। এই দুটি ধারায় যা বলা আছে, তা যদি আপনি মানেন তাহলে আপনার পক্ষে আর কোন নিউজ করা সম্ভব হবে না।

অনেকেই বলছেন, এই আইন করে স্বাধীন মত প্রকাশের পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। এই আইনের ভয়ে মানুষ এখন সত্য কথা বলতে বা লিখতে ভয় পাচ্ছেন৷ যে আইন মানুষের সত্য কথা বলা রুদ্ধ করে সেই আইনটি তো অবশ্যই জনস্বার্থ বিরোধী তাই নয় কি?

অবশ্যই জনস্বার্থ বিরোধী বলেই আমরা মনে করছি। আমরা শুরু থেকেই এর প্রতিবাদ করে আসছি। বাংলাদেশের ইতিহাস যদি দেখেন তাহলে দেখবেন, যখনই কোন স্পেশাল আইন করা হয় সেটা মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করার জন্য। আমি যে উদাহরণগুলো দিলাম সেখানে দেখেন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একটা গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় তো শুধু সরকারি দল থাকে না। এখন যদি শুধু সরকারের দলের কথাই বলা হয়, তাহলে তো আর রাষ্ট্রটা গণতান্ত্রিক থাকে না। এটা অবশ্যই জনস্বার্থ বিরোধী একটা আইন।

এই আইনটি সাইবার অপরাধ, অনলাইনে যৌন হয়রানি, পর্ণোগ্রাফির ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহার হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা কি হচ্ছে?

না, একেবারেই হচ্ছে না। আমার মনে হয়, এই আইনটা যেভাবে আছে সেটা ক্ষমতাসীনরা তাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্য এবং সব ধরনের ভিন্নমত নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই আইনটি করা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রচার করা কার্টুন নিয়েও এখন মামলা হচ্ছে৷ অথচ এমন কার্টুন তো আগে পত্রিকায় প্রকাশ হতো, তখন তো মামলা হয়নি৷

নিশ্চয়। ওই যে কথা হচ্ছে, গণতন্ত্রের প্রতি, বাকস্বাধীনতার প্রতি যে অসহিষ্ণুতা। দেখবেন, মানুষ তখনই ভয় পায়, যখন তার মধ্যে দুর্বলতা আছে। আমি একটুখানি আশঙ্কা প্রকাশ করি, তাহলে কি সরকার ভয় পাচ্ছে? তা না হলে কেন তারা এই কাজগুলো করছেন। সাংবাদিক সমাজের যারা প্রতিনিধি তারা শুরু থেকেই যে আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিলেন সেটা এখন বিবেচনায় নেওয়ার সময় আছে। তা না হলে যেটা হবে এখানে মতপ্রকাশ বলে কিছু থাকবে না। অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, একটা দেশে যদি স্বাধীন গণমাধ্যম থাকে তাহলে ওই দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না। গণমাধ্যম স্বাধীন থাকলে তখন সে সত্যি খবরটা পৌঁছে দেয়। আর গণমাধ্যমে টুটি চেপে ধরলে রাষ্ট্র যারা চালাচ্ছেন তারাও সঠিক খবরটা জানতে পারেন না।

এক্ষেত্রে আইনটি বাতিল করা উচিৎ কি-না? আপনি কি মনে করেন?

আমরা তো বাতিলেরই দাবি জানাচ্ছি। একই সাথে যেটা বলতে চাই, সেটা হলো আমাদের অনলাইনে কিন্তু প্রচুর পরিমানে ভুয়া তথ্য, মানুষের চরিত্র হনন করা, ধর্মীয় প্রচারের মাধ্যমে নারীদের বিরুদ্ধে বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে কটুক্তি করা হচ্ছে। অনলাইনে কিছু শৃঙ্খলা আনার দরকার আছে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে কেউ একজন কিছু একটা লিখলো আর তাকে পাকড়াও করে নিয়ে যাওয়া সেটা কিন্তু কাম্য না। এই আইনটি বাতিল করার পাশাপাশি কিভাবে গ্রহণযোগ্য কাঠামোতে ইন্টারনেট শিক্ষা বাড়ানো যায় সেটা সাধারণ আইনের মধ্যে থেকেই খুঁজে বের করা যায়।

সূত্রঃ ডয়চে ভেলে


আপনার মতামত লিখুন :

মন্তব্য করুন


ফেসবুকে আমরা