April 18, 2024, 2:06 pm

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ

মাহমুদ হাসান ঃ টান টান উত্তেজনা পুরো মাসব্যাপী। শুরু হয়েছিল ৫ অক্টোবর ও শেষ ২৩ অক্টোবর। আর ঘোষণা দিয়ে পুরো বিষয়টিকে কবর দেয়া হলো ২৫ অক্টোবর। ওইদিন ছিল ঈদুল ফিতর। বলছিলাম ২০০৬ সালের অক্টোবরে আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া ও আবদুল জলিলের আলোচিত ও কাঙ্খিত সংলাপ প্রসঙ্গে। রাজনৈতিক সংবাদ সংগ্রহের সুবাদে পুরো বিষয়টির ওপর নজর রাখার সুযোগ হয়েছিল। অসংখ্য প্রিন্ট মিডিয়া থাকলেও তখন বেসরকারি টিভি ছিল মাত্র ৭টি। যাক এর প্রায় মাস দেড়েক আগে বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কুমিল্লায় এক জনসভায় দেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিরোধী দলের সাথে সংলাপে বসার কথা জানান। এ ঘোষনায় সে সময়ের সংঘাতপূর্ণ পরিবেশ ও রাজপথের হিংসাত্মক পরিস্থিতি অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে। দেশ-বিদেশে মানুষের দৃষ্টি সংলাপ দিকে। দুই দিনের মাঝেই বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে চিঠি পাঠানোর কথা জানান। কয়েক দফা চিঠি চালাচালির পর বহুল আলোচিত সংলাপের জন্য নিরপেক্ষ ভেন্যু হিসেবে বেছে নেয়া হয় সংসদ ভবন। ৫ অক্টোবর শুরু হলো দুই নেতার একান্ত সংলাপ। বিরতি দিয়ে ৬ দফায় তা চলল ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত। প্রতিদিনই সংলাপের পর সংবাদ সম্মেলনে তারা জানান, ‘আলোচনা ফলপ্রসূ। আরো আলোচনা হবে।’ এই সংলাপ নিয়ে দেশবাসী যে কতটা উৎসুক ছিল একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে তা পর্যবেক্ষণ করারও সুযোগ হয়েছিল আমার। এখনকার মতো এত সহজে হুট হাট টিভি চ্যানেলগুলোতে সরাসরি সম্প্রচার করা সম্ভব ছিল না। আগের দিন সম্প্রচার যন্ত্রাংশ সেট করে রাখা হতো। সংলাপ চলাকালে যে গুটি কয়েক টিভিতে লাইভ দেখানো হতো তা দেখতে ঘরে-বাইরে, রাস্তায়, দোকান, অফিস বা বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে হুমড়ি পড়ত নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। এদিকে সংসদের মেয়াদ প্রায় শেষ। একই সাথে ঈদের ছুটি শুরু হবে। এই জটিল সমীকরণে ৫ম দিনের সংলাপ শেষ করে দুই নেতা সংবাদ সম্মেলনে জানালেন,’আগামী ২৩ অক্টোবর পরবর্তী সংলাপ।’ এদিকে, সংলাপ দীর্ঘায়িত হওয়ায় সচেতন মহল ছাড়াও দেশবাসী এর ফলাফল নিয়ে শংকার কথা প্রকাশ করতে থাকলেন। বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে এ সংক্রান্ত কয়েকটি রিপোর্টও করেছিলাম। সরকার অনড় সংবিধান অনুযায়ী সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করতে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট এর বিরোধিতা করে রাজপথে। প্রতিদিনই মিছিল, সমাবেশ, প্রতিবাদ চলছে। তবে রোজা আর সংলাপের কারনে এ মাসে উত্তপ্ত রাজনীতি আপাত শান্ত ছিল। কিন্তু সংলাপের ফলাফল নেতিবাচক হলে আগাম শংকার কথা বলছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা। এর মাঝেই ঘনিয়ে আসছিল ৬ষ্ঠ দিনের সংলাপ। সংলাপের বাইরে তখন রাজনৈতিক নেতাদের চাইতে কূটনীতিকদের খুব দৌড়-ঝাঁপ। বিভিন্ন স্থানে চলছে তাদের নানা দেন-দরবার। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতারাও থাকছেন কিছু কিছু সভায়। নির্বাচন কমিশন নিয়েও নানা আপত্তি। সিইসির পদত্যাগ বিরোধীদের অন্যতম দাবী। সেখানেও কূটনীতিকদের অহরহ আনাগোনা। এর মাঝে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ৬ষ্ঠ দিনের সংলাপের আগে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটিনিস দেখা করলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের সাথে। সে সময়ের এ সাক্ষাতের ঘটনা পরবর্তীতে নানা কিছুর জন্ম দিয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এ সাক্ষাতের পরই বিচারপতি কে এম হাসান প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেন। এদিকে, হাতে সময় কম। ঈদের ছুটি, সংসদের মেয়াদ শেষের হাতছানি। এরি মাঝে ২০০৬ সালের ২৩ অক্টোবর সকালে সংসদ ভবনে বসল মান্নান ভূঁইয়া ও আবদুল জলিলের ৬ষ্ঠ দিনের সংলাপ। আজ ইতিবাচক একটা ঘোষণা আসবে- এমনটাই আশা সংলাপ কভার করতে আসা দেশী-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যম কর্মীদের। স্থায়ী কমিটি কক্ষ-১ এর সামনে শতাধিক সাংবাদিক। আর সংসদ ভবনের আশে-পাশে ও টানেলে হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। দলীয় শ্লোগানে মুখরিত পুরো এলাকা। তবে একটি বিষয় খুবই লক্ষ্যণীয় ছিল যে সরকারী দলের চাইতে বিরোধী জোটের নেতা-কর্মীদের সরব উপস্থিতি ঢের বেশি। অন্যান্য দিন এক ঘন্টা বা তারও বেশী সময় ধরে দুই নেতা কথা বলেন। তারপর সংবাদ সম্মেলন। ৬ষ্ঠ দিনের সংলাপ মিনিট বিশেক পরে হঠাৎ সবাইকে অবাক করে দিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে শশব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন দুই নেতা। গণমাধ্যম কর্মীরা দৌড় ঝাঁপ দিয়ে টানেলে এসে তাদের প্রতিক্রিয়া বা সংলাপের সবশেষ পরিণতি কি জানতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কেউই কোন কথা বললেন না। বিএনপি মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া পতাকাবাহী গাড়ীতে চলে গেলেন। এ সময় বিএনপি নেতা-কর্মীরা অনেকটা নিরবে স্থান ত্যাগ করেন। অন্যদিকে, সংসদ ভবনের সংযোগ ব্রীজের ওপর থেকেই দলীয় নেতা- কর্মীদের সাথে নিয়ে গাড়ীতে চড়েন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। গগনবিদারী শ্লোগানে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে অনেকটা বিজয়ের বেশে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে যায় বিরোধী দলের নেতা কর্মীরা। অনেকেই তখন দেশের রাজনীতির ভবিষ্যত দেখতে পেয়েছিলেন। আজ দুই নেতাই প্রয়াত। ইতিহাসবিদ বা গবেষকরা হয়ত বের করবেন ছয়দিনে কি আলোচনা হয়েছিল তাঁদের মাঝে। অথবা কেনই বা ফলাফল শূন্য হলো সংলাপ। তবে ব্যর্থ সংলাপের পথ ধরে যে অপেক্ষা করছিল অন্য রকম দিন- এটা কি জানতেন সে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতা?


আপনার মতামত লিখুন :

মন্তব্য করুন


ফেসবুকে আমরা