স্বদেশ

বানভাসিদের প্রধান সমস্যা বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের

২২ জুলাই ২০১৯, বিন্দুবাংলা টিভি. কম,,দিলারা আক্তার লুনা :

বন্যাকবলিত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ বানভাসি মানুষের। আশ্রয়কেন্দ্র, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও শৌচাগারের সংকট। এতে নানা রোগবালাই দেখা দিলেও মিলছে না পর্যাপ্ত ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- যথেষ্ট ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে এবং পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে।

গাইবান্ধায় ঘাঘট ও ব্রহ্মপুত্রের পানি কিছুটা কমলেও বাঁধ ভেঙে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এ জেলায় বন্যায় এ পর্যন্ত ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের শেরপুর অংশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের একাধিক স্থান ভেঙে শেরপুর সদর, শ্রীবরদী ও নকলা উপজেলার আরও ১০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি রয়েছে জামালপুরের সদর, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ ও বকশীগঞ্জসহ সাতটি উপজেলার অধিকাংশ এলাকা। কুড়িগ্রামে শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়েছে রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারী এলাকায়। ফরিদপুরে পদ্মার পানি বেড়ে জেলার তিনটি উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে পানি ঢুকে পড়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেন, যমুনার ভাঙনে সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের তলদেশে ফাটল দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন তিনি।

ফুলছড়ি (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি জানান, উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের বালাসীঘাট এলাকা থেকে শুরু করে গজারিয়া ইউনিয়নের কাতলামারী পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধজুড়ে আশ্রয় নিয়েছে শত শত বানভাসি পরিবার। সঙ্গে আছে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি। উড়িয়া ইউনিয়নের চরকাবিলপুর গ্রামের বানভাসি আসলাম বলেন, ‘খায়া না খায়া দুথদিন থাহার পর বাড়িঘর ছাইড়া বাঁধে আইলাম। কিন্তু মেম্বার-চেয়ারম্যান এক ছটাক চাউলো দিলো না। হামার গ্রামত হামরাই বেশি গরিব। তাও হামাক কিচু দেয় না।

কেতকীরহাট বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রিত ভুট্টু মিয়া বলেন, ‘বানের পানি যখন ঘরের মধ্যে এককোমর তখন বাঁধে এসে আশ্রয় নিয়েছি। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে আমরা যে টয়লেট সারব তার কোনো ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে নদীর কিনারে সারতে হচ্ছে। আবার সেই পানিতে আমাদের গোসল করতে হচ্ছে, বাসন ও কাপড় ধুতে হচ্ছে। খাবার পানির সংকটও রয়েছে এই বাঁধে।

এদিকে, এসকেএস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় পাওয়ার প্রকল্পের মাধ্যমে বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ১০টি নলকূপ ও ১০টি পায়খানা স্থাপন করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে কম। কঞ্চিপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান লিটন মিয়া বলেন, এ ইউনিয়নে প্রায় সবাই পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ঘরের মেঝেতে কোমরপানি। মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। গরু-ছাগল নিয়ে বানভাসিরা ঘরবাড়ি ছেড়ে নৌকা, উঁচু স্থান ও বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে।

গাইবান্ধার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ফুলছড়িতে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন অসংখ্য বন্যাদুর্গত মানুষ, সেখানে তাদের জন্য নলকূপের পাশাপাশি ৫০টি শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে।

সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি জানান, টানা ১২ দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার পর গত শুক্রবার রাত থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। এর সঙ্গে বানভাসিদের মাঝে দেখা দিয়ে নানা রোগব্যধি, ত্রাণ ও গোখাদ্য সংকট। ইউএনও সোলেমান আলী বানভাসিদের মাঝে নিজে ওষুধ বিতরণ করছেন। প্রয়োজনের তুলনায় মেডিকেল টিমের সংখ্যা অনেক কম। সে কারণে বানভাসিদের ওষুধ পেতে বিলম্ব হচ্ছে। বিশেষ করে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও গোখাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

মানুষের চেয়ে গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন বানভাসিরা। বেলকা চরের রেজাউল ইসলাম জানান, গরু ও ছাগল হলো চরবাসীর বড় সম্বল। প্রতি কোরবানিতে চরবাসী গরু-ছাগল বিক্রি করে লাখ টাকা আয় করে। এ বছর সে আশায় গুড়েবালি। ইউএনও সোলেমান আলী বলেন, পানিবন্দি মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী, ওষুধ ও গোখাদ্য বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। আরও ত্রাণের জন্য চাহিদা পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়ামাত্রই তা বিতরণ করা হবে।

চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, শনিবার রাতে পানির তোড়ে ভেঙে গেছে রমনা রেলস্টেশন থেকে সামান্য দূরে বিজয়নগর গ্রামসংলগ্ন রেললাইন। ভেঙে গেছে রমনা ইউনিয়নের ভরট গ্রাম ওয়াপদা বাঁধ। বিজয়নগর, ছোট কুষ্টারী গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার বানভাসি মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে রেললাইনে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন তারা। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় রয়েছেন শিশু ও বৃদ্ধরা। ভাঙনকবলিত এলাকা থেকে বালাবাড়ী হাট রেলস্টেশনের ব্রিজ পর্যন্ত রেললাইনে প্রায় তিন হাজার পরিবার ঠাসাঠাসি-গাদাগাদি করে দিন কাটাচ্ছে। রেললাইনে অবস্থানকারী শহীদ আলী বলেন, সম্প্রতি কারা যেন আধা মাইল পর পর তিন-চারটি নলকূপ বসিয়েছে। এতে বিশুদ্ধ পানি মিললেও মানুষকে অনেক কষ্ট করে আধা মাইল হেঁটে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

এদিকে হেলিপ্যাড নামক উঁচু স্থানে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির সঙ্গে কমপক্ষে ৫০০ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে আশ্রয় নেওয়া নয়াবাড়ী এলাকার দেলোয়ার হোসেন (৬০) কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘বাড়িতে একতল পানি। ক্ষুধায় পেট জ্বলছে। তবু লজ্জায় কারও কাছে কিছু চাইতে পারছি না।থ বহরের ভিটার ফয়েজ উদ্দিন (৭০) বলেন, চেয়ারম্যান-মেম্বার কেউ এখনও তাদের সাহায্য করেননি।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, যমুনার পানি কমতে শুরু করলেও সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে পানির উচ্চতা রোববার দুপুরে বিপদসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। সিরাজগঞ্জ পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রণজিৎ কুমার সরকার জানান, ঈদের আগে-পরে দ্বিতীয় দফা যমুনায় পানি বাড়ার পাশাপাশি সিরাজগঞ্জ জেলায় বন্যার প্রকোপ দেখা দিতে পারে। নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, শহর রক্ষা বাঁধ হার্ডপয়েন্টসহ প্রতিটি উপজেলায় বাঁধের সেকশন এখনও মোটামুটি ভালো আছে। দুটি ব্লকের মাঝে ফাঁকা ও কিছু অংশ দেবে গেলে দ্রুত সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

চরভদ্রাসন (ফরিদপুর) প্রতিনিধি জানান, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে অন্তত পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে রয়েছে। শনিবার মোবাইল ফোনে কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান জানান, বন্যার্ত মানুষের মাঝে দ্রুত ত্রাণসামগ্রী, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও খাবার স্যালাইন বিতরণ জরুরি হয়ে পড়েছে।

রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। রোববার পাংশা উপজেলার সেনগ্রাম গেজ স্টেশনে পদ্মার পানি বিপদসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম জানান, বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সদর উপজেলার ২০৬ জনের তালিকা করা হয়েছে। অন্য উপজেলার তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। ত্রাণ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।\হবানের পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু :জামালপুরের সরিষাবাড়ী ও নেত্রকোনার কলমাকান্দায় বানের পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যুর খবর দিয়েছেন সমকালের সংশ্নিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা। সরিষাবাড়ী পৌরসভার কামরাবাদ গ্রামের সাখাওয়াত হোসেনের ছেলে ইরান (৩) শনিবার সন্ধ্যায় পানিবন্দি বাড়ির বারান্দায় খেলছিল। বাবা-মায়ের অগোচরে পানিতে পড়ে যায় সে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বারান্দার দেয়ালের পাশে পানিতে ভাসমান অবস্থা থেকে তুলে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেপে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। গতকাল বিকেলে নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার কেলাটি ইউনিয়নের রানীগাঁও গ্রামে বন্যার পানি থেকে জুবায়ের মিয়ার (৫) ভাসমান মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। জুবায়ের ওই গ্রামের দিনমজুর মজিবুর রহমানে ছেলে।

পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস :পাউবোর ৯৩টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের মধ্যে ৩৫টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ৫৩টি পয়েন্টে পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। ২১টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। অপরিবর্তিত আছে পাঁচটি পয়েন্টে। পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, গঙ্গা-পদ্মা ও কুশিয়ারার পানি সমতল স্থিতিশীল থাকতে পারে। ঢাকার চারপাশের ছাড়া দেশের সব প্রধান নদীনদীর পানি সমতলে হ্রাস পাচ্ছে। গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকায় আগামী ২৪ ঘণ্টায় পানি বাড়বে বলেও জানান তিনি।

সূত্র : সমকাল

Related Articles

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না।

Back to top button